নবম শ্রেণি (ভূগোল)


1. পাট শিল্পের সমস্যা গুলির উল্লেখ কর। 

পাট শিল্পের সমস্যা গুলি হল :-
কাঁচা পাটের অভাব: এখন আর কৃষকেরা আগের মতো পাট চাষে আগ্রহী নন, কারণ এতে লাভ কম। ফলে ভালো মানের কাঁচা পাটের জোগান কমে গেছে।
বিকল্প উপকরণের ব্যবহার: আজকাল নাইলন, প্লাস্টিক, কাপড় বা কাগজের ব্যাগের মতো বিকল্প জিনিসের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে।
পুরোনো যন্ত্রপাতি: অধিকাংশ পাটকলেই পুরোনো ও অকার্যকর যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তাই উৎপাদন কম হয়, খরচ বেশি পড়ে এবং জিনিসের মানও ভালো হয় না।
বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা: বিশেষ করে হুগলি অঞ্চলের পাটকলগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত হওয়ায় কাজ প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়।
রপ্তানি শুল্কের সমস্যা: পাটজাত দ্রব্য রপ্তানিতে শুল্ক বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যায়, ফলে বিদেশে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
বিদেশি প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, নেপাল ইত্যাদি দেশের সস্তা ও ভালো মানের পাটপণ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পাটজাত দ্রব্যের তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
শ্রমিক-মালিক বিরোধ: ধর্মঘট, লকআউট, ছাঁটাই ইত্যাদি ঘটনার কারণে পাটকলগুলিতে প্রায়ই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, অনেক কল বন্ধও হয়ে যায়।
অন্যান্য সমস্যা:
নতুন বিনিয়োগের অভাব,
হুগলি নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া,
কারখানার দূষিত পরিবেশ — সব মিলিয়ে এই শিল্পে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, আধুনিকীকরণের অভাব, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং বাজারের প্রতিযোগিতা—এই তিনটি কারণেই পশ্চিমবঙ্গের পাট শিল্প আজ সংকটের মুখে পড়েছে।

2. পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতির কারণ গুলি লেখ।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর উন্নতির মূলে রয়েছে একাধিক ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা:
১. কাঁচামালের প্রাচুর্য: রাজ্যের অনুকূল কৃষি-জলবায়ু থাকার কারণে ধান, পাট, বিভিন্ন ফল (যেমন আম, লিচু), সবজি এবং মাছের প্রচুর উৎপাদন হয়। এই কৃষিজ ও মৎস্য কাঁচামালের সহজলভ্যতা শিল্পের মূল ভিত্তি তৈরি করে।
২. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা: পশ্চিমবঙ্গে সড়কপথ, রেলপথ, জলপথ এবং বিমানপথের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিশেষত, কলকাতা বন্দর এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকায় কাঁচামাল আমদানি এবং প্রক্রিয়াজাত পণ্য দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা খুব সহজ হয়।
৩. বিদ্যুতের সহজ জোগান: তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি এই শিল্পে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ শক্তির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪. জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ও চাহিদা বৃদ্ধি: শিক্ষা, নগরায়ণ এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে রাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রার মান দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে কর্মব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে।
৫. সরকারি সহায়তা ও উদ্যোগ: পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ফুড পার্ক নির্মাণ, লাইসেন্স প্রদান এবং উদার বিনিয়োগ নীতি (যেমন: সহজ ঋণ ও ভর্তুকি) এই শিল্পের বিকাশে প্রধান সহায়ক।
৬. বিশাল দেশীয় বাজার: পশ্চিমবঙ্গ একটি জনবহুল রাজ্য এবং এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের একটি অংশ। এই ক্রমবর্ধমান দেশীয় বাজারের কারণে শিল্পজাত পণ্যের বিক্রি নিশ্চিত হয় এবং বাজারের সম্প্রসারণের হারও বেশি।
৭. অন্যান্য সুবিধা:
হিমায়িত সংরক্ষণাগারের (Cold Storage) সুবিধা (যা কাঁচামালের অপচয় কমায়)।
প্যাকেজিং সামগ্রীর সহজলভ্যতা।
আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সরকারি উৎসাহ।
এই সম্মিলিত কারণগুলির জন্যই পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করছে।

3. দুর্গাপুর কে ভারতের রূঢ় বলা হয় কেন ?

জার্মানির বিখ্যাত রূঢ় (Ruhr) শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে দুর্গাপুরের বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য থাকার কারণে দুর্গাপুরকে ভারতের 'রূঢ়' বা 'ভারতের ইস্পাত নগরী' বলা হয়। এই সাদৃশ্যগুলি প্রধানত ভৌগোলিক অবস্থান এবং শিল্পসম্ভারের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে:
১. নদীর অববাহিকায় অবস্থানগত সাদৃশ্য:
জার্মানির রূঢ় শিল্পাঞ্চলটি যেমন রূঢ় নদীর অববাহিকা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, ঠিক তেমনই ভারতের দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদ দামোদরের তীরে বিকাশ লাভ করেছে। উভয় স্থানেই জলপথের সুবিধা এবং জলের পর্যাপ্ত সরবরাহ শিল্প বিকাশে সহায়তা করেছে।
২. কয়লা-নির্ভরতা ও খনিজ সম্পদ:
রূঢ় শিল্পাঞ্চল তার আশেপাশের অঞ্চলে (ওয়েস্ট ফেলিয়া) প্রাপ্ত উচ্চমানের বিটুমিনাস কয়লার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ঠিক একইভাবে, দুর্গাপুরও তার নিকটবর্তী দামোদর অববাহিকা অঞ্চলের (রানিগঞ্জ, আসানসোল, ঝরিয়া) উচ্চমানের কয়লার প্রাচুর্যকে কেন্দ্র করে উন্নতি লাভ করেছে। এই কয়লা-নির্ভরতা উভয় অঞ্চলের শিল্পায়নের প্রধান চালিকাশক্তি।
৩. শিল্পকাঠামোর মিল:
জার্মানির রূঢ় শিল্পাঞ্চল মূলত লৌহ-ইস্পাত শিল্প, রাসায়নিক শিল্প এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে সমৃদ্ধ। দুর্গাপুরেও প্রধানত বিশাল লৌহ-ইস্পাত কারখানা, তার পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, সিমেন্ট শিল্প এবং অন্যান্য রাসায়নিক শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ, ভারী শিল্পের এই কাঠামোগত মিল দুর্গাপুরকে 'রূঢ়'-এর মর্যাদা দিয়েছে।
৪. জলের প্রাচুর্য:
রূঢ় শিল্পাঞ্চলে যেমন রাইন ও রূঢ় নদীর পর্যাপ্ত জলের সরবরাহ রয়েছে, যা শিল্প এবং জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, ঠিক তেমনি দুর্গাপুরও দামোদর নদ থেকে সারা বছর প্রচুর পরিমাণে জল পেয়ে থাকে। জলের এই নিরবচ্ছিন্ন প্রাপ্যতা ভারী শিল্পের বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
এই সমস্ত ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সাদৃশ্যের কারণেই দুর্গাপুর একটি বিশাল ও কয়লা-নির্ভর শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং একে ভারতের প্রধান শিল্পকেন্দ্র রূঢ়ের সঙ্গে তুলনা করে 'ভারতের রূঢ়' নামে অভিহিত করা হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post